ভূমিকাঃ সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব মনীষী ইসলামি ভাবধারার আলোকে স্রষ্টা, জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসার দার্শনিক অনুসন্ধানের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে শাহ ওয়ালীউল্লাহ অন্যতম। জগৎ এবং জীবন সম্পর্কিত চিন্তা তার মূল উৎস ও প্রেরণা ছিল ইসলাম ধর্ম মুসলিম দর্শন। তবে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। তিনি তার মানুষের ধর্ম গ্রন্থটিকে দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দিব্য আলােচনা করেছেন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ এর দর্শন তত্ত্বঃ শাহ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন একজন বড় মাপের দার্শনিক। তিনি যথার্থ দার্শনিক কলাকৌশল বাস্তব জীবন প্রয়ােগের পক্ষপাতি ছিলেন। স্রষ্টা, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তার সূত্র ইসলাম ধর্ম হলেও তিনি তাঁর দর্শন তত্ত্বের চিন্তাকে উদ্দেশ্য করেননি, বরং আরাে সমৃদ্ধ করেছে। নিম্নে তাঁর দর্শন তত্ত্ব আলােচনা করা হলো:
-
১. বিশ্বময় চেতনার বাস্তবতাঃ শাহ ওয়ালীউল্লাহর দার্শনিক জিজ্ঞাসার বিষয় ছিল জগৎ জীবন, জড়, মন বা আত্মা, ইহজগৎ, পরজগৎ প্রভূতি। তিনি এসব জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধানে সচেষ্ট ছিলেন। আমরা যদি দর্শনের ইতিহাস পর্যালােচনা করি তাহলে প্রধান দুটি ধারা দেখতে পাই। যথা- ১। জড়বাদ, ২।অধ্যাত্মবাদ। জড়বাদীরা সবকিছুকে জড়ের আলােকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। তারা জগতের উৎসের পছনে কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। অন্যদিকে আধ্যাত্মিক জগতের সবকিছু জড়-অজড়, চেতনা- অচেতন সকল সত্তাকে ব্যাখ্যা করতে এক বিশ্বময় চেতনার আধ্যাত্মা সত্তাকে স্বীকার করেছেন।
-
২. বিশ্বময় চেতনাকে অনুধাবন ও অনুকরণ : শাহ ওয়ালীউল্লাহ এর বিশ্বময় চেতনার কথা বলার পাশাপাশি সে সত্তাকে অনুধাবন ও অনুকরণ করার উপর জোর দিয়েছেন। আর এ চেতনার সত্তাকে জানা ও অনুকরণ করার মধ্যে রয়েছে মানবাত্মার সার্থকতা। আর সকল প্রকার অবক্ষয় ও অশান্তির মূল রয়েছে সে সত্তা থেকে দূরে সরে যাওয়ানবা সে সত্তা থেকে পদস্থলন ঘটা। তিনি বলেন, মৎস্যে যেমন পানিতে জীবনের স্বার্থকতা অনুভব করে, শিশু যেমন মাতৃক্রোড়ে সর্বাপেক্ষা স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে আত্মাও তেমনই একমাত্র পরমার্থেই আপনাকে সম্পূর্ণরপে প্রকৃতিস্থ মনে করে। এ বিশ্বময় চেতনাকে অনুধাবন ও অনুকরণের জন্য ধর্মীয় প্রগাঢ় অনুভূতি অর্জন করতে হবে।
-
৩. আত্মার অমরত্বেরে ধারণা: আত্মার অমরত্ব ধারণা এমন ধারণা যেভাবে মানুষের মৃত্যু হলেও আত্ম ধ্বংস হয় না আত্মা চির অমর। কাব্যে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দর্শন চিন্তায় আত্মার অমরত্বের ধারণা প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, ধর্ম সাধারণ কেন্দে রয়েছে সেই অসীম আল্লাহ যিনি পুণ্যবানদের পুরস্কৃত করবেন এবং পাপাত্মাদের শাস্তি দিবেন। এজন্য মৃত্যুর পর পাপ ও পূণ্যের হিসেবে দেওয়ার জন্য আত্মাকে অবশ্যই অমর হতে হবে।
-
৪. আল্লাহকে জানার উপায় : শাহ ওয়ালীউল্লাহ আল্লাহকে জানা বা উপলদ্ধি করার উপায়ও নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও হৃদয়বান। তাই মানুষ যদি আল্লাহকে উপলদ্ধি করতে চায় তাহলে তাকে মরমি অভিজ্ঞতার আলোকে উপলদ্ধি করতে হবে। এই উপলদ্ধি মানুষের অন্তরের অন্তরতম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে।
-
৫. আত্মপ্রতিষ্ঠার ধারণা: শাহ ওয়ালীউল্লাহ দর্শনে আত্ম প্রতিষ্ঠান একটি শক্তিশালী আত্মপ্রতিষ্ঠান জীব ও জড়ের এক স্বাভাবিক ধর্ম। অচেতন, নিষ্প্রাণ শিলাখণ্ড ও প্রকৃতিতে তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। তাকে কেউ অপসারণের চেষ্টা করলে সে প্রতিরােধ করে। তাই কেউ তাকে পদাঘাত করলে সে পদাঘাতকারীকে বেদনা দেন।
-
৬. উদ্দেশ্য নয় চালক সত্তার উপস্থতি: শাহ ওয়ালীউল্লাহ বলেন, মানুষের সকল সচেতন প্রেরণা সুনিয়ন্ত্রিত ও সুচালিত। এক উদ্দেশ্যময় চালক সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেছেন। তিনি যেন কোনাে নিপুণ পথবাহী আকিয়া বাকিয়া, বনতরুর ধীরে ধীরে চলা নদীর আঁকে-বাঁকে। মুক্ত মাঠের উদাস বুকে সুজনের গান গাহিয়া চলিয়েছে। একথার অর্থ হলাে এক ধরনের চালক আছেন বলেই ভবিষ্যৎ চমৎকারভাবে রচিত হচ্ছে বর্তমানের উপর, জগতের উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্যু সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে সেই পরমসত্তা সুনিপুণ সুনিয়ন্ত্রিত চালকের দ্বারা।
-
৭. জড়বাদির বিরােধিতা: ওয়ালীউল্লাহ দর্শন তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে তিনি জড়বাদের ভূমিকাকে স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, জড়বাদ প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপরই নির্ভরশীল থাকে। প্রত্যক্ষণাকে তারা অকাট্য প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে। এর বাইরে কোনাে কিছুর অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। এজন্য এ মতবাদ মানুষের অন্তর্লোকের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
-
৮. স্বত্তার ধারণা: ওয়ালীউল্লাহ দর্শনত্ত্বের একটি গুরুতুপূর্ণ দিক হলাে সত্তার ধারণা। তাঁর মত, পরমসত্তা বা বিশ্বময় চেতনা সত্তাকে বৃদ্ধি বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সরাসরি জানার নয়। এজন্য প্রয়ােজন অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি বা সত্তার। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির নিকট ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান বলে কিছু নেই। এটি সকল দেশের সকল কালের উর্ধে। এই অনুভূতি এমনই এক বিশ্বয়কর একটি বস্তু যে সেটি আমাদের জীবন রহস্য সম্পর্ক, দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করতে সহায়তা করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ তার ব্যস্ততম কর্মময় জীবনে শুধু আত্মস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুখভোগ ব্যাপৃত না থেকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তার সুনিশ্চিত মতামত লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তার জীবনে তিনি যে দার্শনিক মতের উপর আস্থাশীল ছিলেন তা হচ্ছে সত্তা। তবে তিনি জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে বুদ্ধিকে একেবারে ফেলে দেননি এবং বিজ্ঞানকে অকার্যকর করেননি।